সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংক বিভিন্ন প্রকার হিসাব খোলার সুবিধা প্রদান করে। সকল শ্রেণির জনগণের ব্যাংকিং চাহিদা একরকম হয় না। ফলে একজাতীয় হিসাবের মাধ্যমে জনগণের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য ব্যাংকিং চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রেখে ব্যাংক হিসাবকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। নিছে তা ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো-
ক. চলতি হিসাব (Current account) :
যে হিসাবের মাধ্যমে আমানতকারীকে চাহিবামাত্র অর্থ পরিশোধ করা হয় তাকে চলতি হিসাব বলে। অর্থাৎ যে হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংক চলাকালীন সময়ে ইচ্ছামতো অর্থ উত্তোলন বা জমা রাখা যায় সেটি চলতি হিসাব। কমপক্ষে ৫০০ টাকা জমা দিয়ে এ হিসাব খুলতে হয়। চলতি হিসাবে কোনো প্রকার সুদ প্রদান করা হয় না। চলতি হিসাবের আমানতকারীগণ ব্যাংক থেকে জমাতিরিক্ত ঋণের সুবিধা পেয়ে থাকে। এ ধরনের হিসাব সাধারণত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বড় বড় কারবারী প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ খুলে থাকেন। চলতি হিসাবের দু'টি ধরন আছে। যথা-
১. সাধারণ চলতি হিসাব (General current account): এ হিসাবে ব্যাংকিং সময়ে যতবার ইচ্ছা টাকা জমা দেওয়া এবং তোলা যায়। ব্যাংক এ ধরনের আমানতের ওপর কোনো প্রকার সুদ দেয় না।
২. বিশেষ চলতি হিসাব (Special current account): এ ধরনের চলতি হিসাবে বেশি পরিমাণ অলস অর্থ জমা থাকে এবং এ জমা করা অর্থ স্বল্পকালীন আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে এর বিপরীতে ব্যাংক অল্প সুদ দিয়ে থাকে।
খ. সঞ্চয়ী হিসাব (Savings account) : সাধারণত নির্দিষ্ট এবং স্থির আয়ের লোকজন সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে যে হিসাব খোলে তাকে সঞ্চয়ী হিসাব বলা হয়। ব্যাংকিং সময়ে যতবার খুশি এ হিসাবে অর্থ জমা করা যায় কিন্তু কিছু বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে টাকা উত্তোলন করতে হয়। তবে বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সপ্তাহে দু'বারের বেশি অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেয়। এরূপ হিসাব নিম্নোক্ত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে—
১. গৃহ সঞ্চয়ী হিসাব (Home savings) : ব্যাংক যে হিসাবের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ সৃষ্টি করে থাকে তাকে গৃহ সঞ্চয়ী হিসাব বলে। এ হিসাবের জন্য ব্যাংক স্বপ্ন হারে সুদ দিয়ে থাকে।
২. স্কুল সঞ্চয়ী হিসাব (School savings accounts): যে হিসাবের মাধ্যমে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয় তাকে স্কুল সঞ্চয়ী হিসাব বলা হয়।
৩. মহিলা সঞ্চয়ী হিসাব (Female savings accounts): যে হিসাবের মাধ্যমে সমাজের মহিলাদের মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে তাকে মহিলা সঞ্চয়ী হিসাব বলে ।
৪. শ্রমিক সঞ্চয়ী হিসাব ( Laboure savings accounts): যে হিসাবের মাধ্যমে শিল্প এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে সঞ্চয়ের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয় তাকে শ্রমিক সঞ্চয়ী হিসাব বলা হয়। শ্রমিকগণ তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় এ হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা রাখে।
গ. স্থায়ী হিসাব (Fixed account): যে হিসাবে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ বা সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে টাকা জমা দেওয়া হয় তাকে স্থায়ী হিসাব বলে। এই হিসাবের উপর উচ্চহারে সুদ দেওয়া হয়। এ হিসাবে আমানতকারী প্রয়োজনে তার আমানতের বিপরীতে ৮০% পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। তবে ঋণের উপর ব্যাংক কর্তৃক ধার্যকৃত হারে সুদ দিতে হয়। এটি অধিক লাভে নিরাপদ বিনিয়োগ । যাদের অলস অর্থ হাতে থাকে তাদের জন্য এ হিসাব লাভজনক। স্থায়ী হিসাব দু'ধরনের হয়ে থাকে। যথা-,
১. সাধারণ স্থায়ী হিসাব (General fixed account) : যে স্থায়ী হিসারের মাধ্যমে কমপক্ষে ৩ (তিন) মাস এবং সর্বোচ্চ ১০ (দশ) বছর বা ততোধিক সময়ের জন্য টাকা জমা রাখা হয় তাকে সাধারণ স্থায়ী হিসাব বলে।
২. বিশেষ মেয়াদি স্থায়ী হিসাব (Special fixed account) : যে স্থায়ী হিসাবের জমাকৃত অর্থ ব্যাংক আমানতকারীকে ৭ (সাত) দিনের নোটিশ অন্তে পরিশোধ্য এবং নির্দিষ্ট হারে ব্যাংক সুদ প্রদান করে তাকে বিশেষ মেয়াদি স্থায়ী হিসাব বলে।
ঘ. বিশেষ হিসাব (Special account) :
১. বিমা সঞ্চয়ী হিসাব (Insurance saving account) : এই হিসাবে সঞ্চয়ী হিসাবের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও আমানতকারী স্বল্প ব্যয়ে জীবন বিমার অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে।
২. পেনশন জামানতি হিসাব (Pension account) : প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে এককালীন অথবা পেনশনের মতো কিস্তিতে চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফাসহ মোট পাওনা শর্তে যে হিসাব খোলা হয় তাকে পেনশন জামানতি হিসাব বলে । যেমন : ডিপাজিট পেনশন স্কীম (DPS)।
৩. পৌনঃপুনিক হিসাব (Recurring account): যে হিসাবের মাধ্যমে আমানতকারী নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে বারবার অর্থ জমা দিতে পারে এবং মেয়াদ শেষে এককালীন টাকা উত্তোলন করতে পারে তাকে পৌনঃপুনিক হিসাব বলে ।
৪. ঋণ আমানাত হিসাব ( Loan account) : ঋণ প্রদানের সময় ব্যাংক যে হিসাবে মঞ্জুরকৃত ঋণের অর্থ ঋণগ্রহীতার নামে ক্রেডিট করে তাকে ঋণ আমানত হিসাব বলে।
৫. বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব (Foreign currency account): যে হিসাবের মাধ্যমে বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের অর্জিত টাকা দেশে অবস্থিত কোনো ব্যাংকে জমা রাখা হয় তাকে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব বলা হয়। উপরিউক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, জনগণের ব্যাংকিং চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রেখে ব্যাংক বিভিন্ন প্রকার হিসাব খোলার সুবিধা প্রদান করে। ব্যাংকের কাজই হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে জনগণকে নিরাপদে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা।
জনগণের কর্মকান্ড বহুমুখী হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকের হিসাবও বহুমুখী হচ্ছে। আর ব্যাংকের হিসাব বহুমুখী হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকের সংখ্যা এবং মুনাফা উভয়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সঞ্চয়ী হিসাব ও স্থায়ী হিসাবের মধ্যে পার্থক্য :
সঞ্চয়ী হিসাব | স্থায়ী হিসাব |
---|---|
যে হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংকিং সময়ে একাধিকবার টাকা জমা রাখা যায়, কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম | মেনে অর্থ উত্তোলন করতে হয় তাকে সঞ্চয়ী হিসাব বলে। | যে হিসাবের টাকা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংকে জমা রাখা হয় এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে সাধারণত টাকা উত্তোলন করা যায় না তাকে স্থায়ী হিসাব বলে। |
সঞ্চয়ী হিসাবের ক্ষেত্রে নির্ধারিত আবেদনপত্র পূরণের মাধ্যমে হিসাব খুলতে হয়। | এ হিসাবের ক্ষেত্রে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ পূরণ করে আমানতকারী হিসাব খুলতে পারে। |
এ হিসাব খুলতে গ্রাহককে তৃতীয় পক্ষের পরিচিতিকরণের প্রয়োজন পড়ে। | স্থায়ী হিসাবের ক্ষেত্রে পরিচিতিকরণের প্রয়োজন হয় না। |
স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের লোকের জন্য এ হিসাব উপযোগী। | যাদের হাতে অলস অর্থ জমা থাকে তাদের জন্য এ হিসাব উপযোগী। |
মক্কেলদের চেক ও পাস বই দেওয়া হয়। | মক্কেলদের স্থায়ী আমানত রসিদ দেওয়া হয়। |
অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হয় | মেয়াদপূর্তির আগে সাধারণত টাকা তোলা যায় না । |
কিছু বিশেষ শর্ত অনুসরণ করে নাবালক ব্যাংক হিসাব খুলতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংক নাবালকের স্বাক্ষর গ্রহণ ছাড়াও তার জন্ম তারিখ ও প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার তারিখ নমুনা স্বাক্ষরের কার্ডের ওপর লিখে রাখে। গ্রাহক প্রাপ্ত বয়স্ক হলে ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
Read more